দর্শন বিভাগ
6th SEM (HONS)
বিশ্বজনীন ধর্মের প্রকৃতি ও আদর্শ:
এটা ঐতিহাসিক ঘটনা যে পৃথিবীতে নানা রকমের ধর্মীয় অথবা আধ্যাত্মিক সংগঠন আছে।তাদের আচার বিশ্বাসও আলাদা এটাও ঐতিহাসিক ঘটনা যে বহু প্রাচীনকাল থেকে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এইসব ধর্ম গুলো পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে যাচ্ছে। প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ই এমন দাবি করে যে তাদের সংগঠনই সকলের চেয়ে উত্তম।তাই তারাই পৃথিবীতে থাকার যোগ্য।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই যে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্ম মত গুলির মধ্যে এত প্রকাশ্য ও কুৎসিত বিরত থাকা সত্ত্বেও সকল ধর্ম গুলি ই বেঁচে আছে। ধর্মমত গুলির এই অন্তর ও বাহ্য কলহ তাদের দুর্বল করার পরিবর্তে সংযুক্ত করেছে জীবনীশক্তি এবং তাদের বিস্তার ঘটানোয় সাহায্য করেছে।
এ ঘটনা বিবেকানন্দের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। এই ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে এই আপাত বিরোধ কোনভাবেই ধর্মগুলির অন্তর জীবনী শক্তিকে অথবা ধর্মের মূল সত্তাকে প্রভাবিত করে না। বিবেকানন্দ স্বীকার করেছেন যে বিভিন্ন ধর্ম গুলির মধ্যে যেমন বিরোধ আছে তেমনি প্রত্যেক ধর্মমতের ভেতরেও সম্প্রদায়গত কলহ আছে
কিন্তু প্রশ্ন হলো কীভাবে এই বিভিন্ন ধর্ম সত্য হতে পারে? কিভাবে বিভিন্ন বিরোধী মতামত একই সময় সত্য হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরেই নির্ভর করছে বিশ্বজনীন ধর্মের ভাগ্য।একটি বিশ্বজনীন ধর্ম যদি প্রকৃতই বিশ্বজনীন হয় তবে সেটি পূরণ করবে অন্তত দুটি শর্ত। প্রথমত এটি অবশ্যই এর দরজা খোলা রাখবে সকল বিশেষ ব্যক্তির জন্য। এটি অবশ্যই স্বীকার করবে যে কোন ব্যক্তি এই অথবা ঐ বিশেষ ধর্মের জাত নয়।কে কোন ধর্ম গ্রহণ করবে না ত্যাগ করবে সেটা তার নিজের অন্তরের নির্বাচনের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত একটি প্রকৃত বিশ্বজনীন ধর্ম সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সন্তুষ্টি এবং স্বাচ্ছন্দ বিধান করে একটি বিশ্বজনীন ধর্ম পরিণামে সকল সম্প্রদায়গত বিরোধকে অতিক্রম করতে সমর্থ হয় ফলে তাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। তাই একটি প্রকৃত বিশ্বজনীন ধর্মের সকল ব্যক্তি বিশেষ তাঁর আধ্যাত্মিক মনের পুষ্টি লাভ করে।
অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বিবেকানন্দ এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রথমত বিভিন্ন ধর্মের প্রকৃতিকে যদি আমাদের সামান্যতম অন্তর্দৃষ্টি সাহায্যে বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব তারা কখনোই একে অপরের বিরুদ্ধতা করছে না। প্রকৃতপক্ষে, তারা একে অপরের পরিপূরক এর কাজ করছে। ধর্মের সত্যতা এত সামগ্রিক উপলব্ধিমুলক যে বিভিন্ন ধর্মমতগুলি ধর্মের একটি দিককে অথবা কয়েকটি দিকে নিজেদের উপলব্ধির ক্ষেত্রকে নিয়োজিত করছে। এভাবে এক একটি ধর্ম তাদের সমস্ত শক্তিকে নিজেদের নির্বাচিত একটি দিকে নিয়োজিত করে ভাবছে ধর্মের আর কোনো দিক নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ধর্মের একেকটি দিককে বিকশিত করছে প্রত্যেক ধর্ম। সুতরাং প্রত্যেক ধর্মই সমৃদ্ধ করছে শাশ্বত ধর্মের এক একটি দিককে।হতে পারে সম্প্রদায়গত ধর্মগুলি আংশিক দৃষ্টিকোণ থেকে শাশ্বত ধর্মকে ব্যাখ্যা করছে, কিন্তু বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন মানুষ কখনো মিথ্যা থেকে সত্যে উন্নীত হতে পারে না,
সত্য থেকেই সত্যে উপনীত হতে হয। অপেক্ষাকৃত নিম্ন সত্য থেকে উচ্চ সত্যে উপনীত হয় মাত্র। দ্বিতীয়তঃ একই বিষয়ের বিরুদ্ধ দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে। যেমন যদি আমরা একই বস্তুর ফটোগ্রাফি নিই বিভিন্ন কোণ থেকে সেগুলো ঠিক একই রকমের হবেনা। এমনকি বিপরীত হতে পারে। কিন্তু ফটোগ্রাফগুলি যে একই বস্তুর সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেরকম আমরা একই সত্যকে দেখছি আমাদের নিজের নিজের মতো করে। নিজের মনের রঙে রাঙিয়ে নিচ্ছি। বুঝছিও নিজের মত করে।এর থেকেই মানুষে মানুষে তফাৎ হচ্ছে আর আমাদের মনে হচ্ছে একের সঙ্গে অপরের বিরুদ্ধতা আছে। কিন্তু মূলে সকল ধর্ম একই সত্য প্রকাশ করছে, তাই একে অপরের পরিপূরকেরই কাজ করছে।
বিবেকানন্দ দুটি বিষয়কে সর্বজনীন বলে চিহ্নিত করেছেন তাদের প্রথমটি হলো গ্রহণ শব্দটিকে তিনি পর ধর্ম সহিষ্ণুতার করার ক্ষমতা হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং প্রকৃত অর্থেই বিশ্বজনীন ধর্ম হল সবকিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা বিশেষ। দ্বিতীয়তঃ সাধারণ বিষয় বিশ্বজনীন ধর্মে ঈশ্বর। এক ঈশ্বরের ধারণা অবলম্বনে পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মসমূহ সম্বন্ধযুক্ত হয়ে আছে। বিবেকানন্দ বলছেন এক প্রভু বলছেন আমি মনিগণের মধ্যে সূত্ররূপে বর্তমান রয়েছি।
আমরা সকলেই মানুষ অথচ আমরা সকলেই পরস্পর পৃথক। মনুষ্যজাতির অংশ হিসাবে আমি এবং আপনি এক। কিন্তু যখন আমি অমুক তখন কিন্তু আমি আপনার থেকে পৃথক। পুরুষ হিসেবে আপনি নারী থেকে ভিন্ন, কিন্তু মানুষ হিসেবে নর ও নারী এক।মানুষ হিসেবে আপনি জীবজন্তু থেকে পৃথক, কিন্তু প্রাণী হিসেবে নারী,পুরুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ সকলেই সমান এবং সত্তা হিসেবে আপনি বিরাট বিশ্বের সঙ্গে এক। আর সেই বিরাট সত্তাই ঈশ্বর, তিনি এই বৈচিত্র্যময় জগৎ প্রপঞ্চের চরম একত্ব।