Philosophy (Hons),
2nd sem
ধারণার সম্বন্ধ ও বস্তুস্থিতি বা বাস্তব ব্যাপার:
(Relations of ideas and matters of fact)
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউম তার 'ইনকোয়্যারি 'গ্রন্থে মানুষের সমস্ত জ্ঞানের বিষয় কে দুটি ভাগে বিন্যস্ত করেছেন, যথা - ধারণার সম্বন্ধ এবং বস্তুস্থিতি বা বাস্তব ব্যাপার। তার পূর্বে প্রকাশিত তার 'ট্রিটিজ' গ্রন্থেও অনুরুপ বিভাগের উল্লেখ আছে। তবে ট্রিটিজ গ্রন্থে হিউম জ্ঞানের বিষয়ের পরিবর্তে দর্শন সম্মত সম্বন্ধ কে দুটি ভাগে বিন্যস্ত করেছেন।
ইনকোয়্যারি গ্রন্থে হিউম যে বিভাগের উল্লেখ করেছেন তা সম্বন্ধের বিভাগ নয়,
তা হল জ্ঞানের বিষয় বস্তুর বিভাগ। বলা যায় এই বিভাগ দুই ধরনের জ্ঞানের এবং জ্ঞানের বিষয়ের বিভাগ। আবার যেহেতু জ্ঞান প্রকাশ পায় বচনে, সেহেতু এমনও বলা যেতে পারে যে এই বিভাগ দুই প্রকার বচনের বিভাগ। এই বিভাগ হিউমের দ্বি-বিভাগতত্ত্ব নামে পরিচিত। বিষয় অনুসারে জ্ঞান দুই প্রকার - ধারণার সংগে ধারণার সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান এবং ধারণার সংগে তথ্যের বা ব্যাপারের সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান। প্রথম প্রকার জ্ঞানের বা বচনের বিষয় বিমূর্ত ধারনা এবং দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞানের বা বচনের বিষয় মূর্ত তথ্য বা ব্যাপার। প্রথম প্রকার জ্ঞানের বিষয় হল অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ বুদ্ধিলব্ধ প্রত্যয় বা ধারণা এবং দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞানের বিষয় হল অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ বাস্তব বিষয়। গাণিতিক জ্ঞান হল ধারণার সংগে ধারণার সম্বন্ধ বিষয়ক প্রথম প্রকার জ্ঞান। এজাতীয় জ্ঞান হিউমের মতে স্বজ্ঞামূলক অথবা প্রমান মূলক। তবে গাণিতিক জ্ঞান প্রমান মূলক হলেও তাদের সঠিক অর্থে স্বজ্ঞামূলক বলা চলে না। হিউম সম্ভবত ন্যায়শাস্ত্রের জ্ঞান কেই স্বজ্ঞামূলক বলেছেন। দ্বিতীয় প্রকার বাস্তব বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞানের বিষয় হল- ইতিহাস,ভুগোল, রাস্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন প্রভৃতি অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ তথ্যাদি।
দুপ্রকার বচনের মধ্যে পার্থক্যঃ
প্রথম পার্থক্য- ধারণার সংগে ধারণার সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান মাত্রই অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ বা পূর্বতঃসিদ্ধ। হিউমের ভাষায় জাগতিক কোন তথ্য বা বাস্তব বিষয়ের উপর নির্ভর না করে শুধুমাত্র চিন্তনক্রিয়া বা বুদ্ধিক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতীয় জ্ঞান বা বচন কে জানা যায়। যেমন - অতিভুজের বর্গ ক্ষেত্র হল তার দুই বাহুর বর্গক্ষেত্রের যোগফলের সমান,পাচের তিনগুন হল ত্রিশের অর্ধেক। গাণিতিক বচন মাত্রই এজাতীয়। গাণিতিক বচনে কেবল এক ধারণার সংগে অন্য এক ধারণার সম্বন্ধ নিরধারন করা হয়। গাণিতিক বচনে জাগতিক কোন তথ্য বা ব্যাপারের উল্লেখ থাকে না এবং সেজন্য অভিজ্ঞতার কোন প্রয়োজন হয় না।
পক্ষান্তরে বস্তুস্থিতি বা বাস্তব বিষয়ের জ্ঞান কেবল বুদ্ধিক্রিয়ার মাধ্যমে লাভ করা যায় না,
বস্তুস্থিতি- বিন্যাস কে জানার জন্য অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন হয়। কাজেই এ জাতীয় জ্ঞান বা বচন পূর্বতঃসিদ্ধ নয়,
তা অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ বা পরতঃ সাধ্য। হিউম এজাতীয় জ্ঞানের যে উদাহরণ দিয়েছেন তা হল - আগামীকাল সূর্য পূর্ব দিকে উঠবে অথবা উঠবে না। আগামীকাল সূর্য পূর্ব দিকে উঠবে কী উঠবে না - তা ধারণাগত সম্বন্ধ নিরধারন করে অথবা শব্দপ্রতীকের অর্থ বিশ্লেষণ করে জানা যায় না,
তা জানতে হলে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।
দ্বিতীয় পার্থক্যঃ ধারণার সংগে ধারণার সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান অস্বীকার করলে তা হয় স্ববিরোধী জ্ঞান, এ জাতীয় জ্ঞান বা বচনের নিষেধ বচন চিন্তা করাই যায় না। ২ এবং ৪ সংখ্যা দুটির অর্থ জানা থাকলে '২+২=৪ ' এই বচনটির নিষেধ চিন্তা করাই যায় না। এমন চিন্তা করলে চিন্তার জগতে স্ববিরোধিতা দেখা দেয়। এজাতীয় গাণিতিক বচন স্বতঃসত্য বচন এবং ফলত এজাতীয় বচনের নিষেধ বচন স্বতঃমিথ্যা বচন।
পক্ষান্তরে বস্তুস্থিতি বা বাস্তব বিষয়ের জ্ঞান এমন নয়,কেননা এজাতীয় জ্ঞানের বিপরীত জ্ঞান স্ববিরোধী হয় না,
এজাতীয় জ্ঞানের নিষেধ করলে চিন্তার জগতে কোন বিরোধিতা দেখা দেয় না। আগামীকাল সূর্য উঠবে - এই ইতিবাচক বচনটার মতোই আগামীকাল সূর্য উঠবে না- এই নিধেধ বচনটিও আমাদের কাছে স্পষ্ট এবং বিরোধহীন রুপে অনুভূত হয়। কথাটির মাধ্যমে হিউম এমন বলেন না যে - আগামীকাল সূর্য উঠবে কথাটি মিথ্যা। তিনি কেবল এটাই বলেন যে - আগামীকাল সূর্য উঠবে না - এমন চিন্তার মধ্যে কোন যৌক্তিক বিরোধিতা নেই।
গুরুত্ব ঃ হিউম উল্লিখিত বচনের দুপ্রকার বিভাগ দর্শণের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব পূর্ণ। প্রথম প্রকার ধারণার সম্বন্ধ বিষয়ক পূর্বতঃসিদ্ধ বচন কে আধুনিক পরিভাষায় বলা হয় বিশ্লেষক বচন, আর দ্বিতীয় প্রকার বাস্তব বিষয় সংক্রান্ত পরতঃসাধ্য বচনকে আধুনিক পরিভাষায় বলা হয় সংশ্লেষক বচন। সাম্প্রতিককালের ন্যায়গত প্রত্যক্ষবাদীদের মতে পূর্বতঃসিদ্ধ বচন মাত্রই বিশ্লেষক ও অনিবার্যরুপে সত্য এবং পরতঃসাধ্য বচনমাত্রই সংশ্লেষক, এ প্রকার সংশ্লেষক বচনের নিষেধ বচন বাস্তবত মিথ্যা হলেও স্ববিরোধী হয় না। এই দুই প্রকার বচন ছাড়া মধ্যবর্তী আর কোন বচন নেই।