Thursday, April 30, 2020

6th Sem Honours Topic (Proofs for Gods existence)

ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ (Proofs for Gods existence):

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বোচ্চ সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ দাখিল করার তাগিদ অনুভব করেননি। কারণ ঈশ্বরকে খুব বেশি বৌদ্ধিক এবং বিমুর্ত যুক্তিজালে তিনি বাঁধতে চাননি। তাঁর কাছে ঈশ্বর ছিল অস্তিত্বের পূর্ব শর্ত------তাই তার প্রমাণ অপ্রয়োজনীয়।সর্বোচ্চ সত্তার অস্তিত্ব নিজের ভেতর থেকে উপলব্ধির বিষয়--যৌক্তিক ব্যাখ্যার বিষয় নয়।বৌদ্ধিক যুক্তি দ্বারা ঐশ্বরিক একত্বকে অনুধাবন করা সম্ভব নয় বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন।
    কিন্তু কবিগুরু এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, সাধারণ কথাবার্তায়,দৈনন্দিন জীবনে, বৌদ্ধিক প্রমাণ এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যা একটা ভূমিকা পালন করে।যাদের মধ্যে ঈশ্বরের ব্যক্তিগত উপলব্ধি নেই,যুক্তি-প্রমাণ সকল তাদের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এক জাতীয় শক্তি যোগায়। এটা বুঝেই তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন যাকে 'প্রমাণ' বলা যায়।এই প্রমাণগুলোর কিছু কিছু দর্শনের প্রথাসিদ্ধ প্রমাণের অনুরূপ,আর কিছু কিছু তার নিজের অন্তদর্শন লব্ধ।
    তাঁর অন্যতম প্রিয় ঈশ্বর বিষয়ক প্রমাণ হল,দর্শনের প্রথাসিদ্ধ ভাষায় যাকে বলা হয় উদ্দেশ্য মূলক যুক্তি বা পরিকল্পনা ভিত্তিক যুক্তি।কবি নিজে ছিলেন শৃঙ্খলা এবং সুন্দরের প্রেমিক।স্বাভাবিকভাবেই তাঁর যুক্তির সাক্ষ্যপ্রমাণ এসেছে জগতের শৃঙ্খলা কিভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তার উদাহরণ দিয়ে।তিনি 'সৃষ্টির ঐক্য' প্রসঙ্গে লিখেছেন: আমরা অনুভব করি এই জগত এক সৃষ্টি,এর কেন্দ্রে আছে এক জীবন্ত আদর্শ,যা নিজেকে প্রকাশ করছে এক চিরন্তন ঐক্যতানকে, যা  সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের সহযোগিতায়,প্রত্যেকেই যথাযথ সুরে যাকে বাজাচ্ছে। কবি বিশ্বাস করতেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক সৃষ্টিকর্তাকে-যে সমগ্র জগতে এক নিয়ম শৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।এই বিশ্বজগত কবির কাছে প্রকাশিত হয়েছে 'ঐক্যতান' রূপে।যেখানে সংগীতের সমস্ত মুচ্ছনা প্রকাশ পেয়েছে এক শৃঙ্খলিত আকারে,আর এক অসীম 'সংগীত-সৃষ্টিকারী' ছাড়া এই ঐক্যতানকে ব্যাখ্যা করা যায়না।দর্শনের ছাত্র  একেই উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির একটি বিশেষ আকার রূপে চিহ্নিত করতে পারেন।
    একই যুক্তি তিনি অন্যত্র অন্যভাবে উল্লেখ করেছেন।কবি অনুভব করেছেন,এই জগৎ-এ সমগ্রতা ও ঐক্যতা প্রকাশিত হয় পরিণামে। যদিও আপাত বিরোধিতা দেখা যায় বাস্তব ঘটনা সমূহের মধ্যে।যদি আমরা বাহ্যিক বিরুদ্ধ বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ করি,আমরা দেখতে পাবো তাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য আছে। কবির কাছে এটি খুব উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে।যেমন,নদীর দুই কুল বাহ্যিকভাবে নদী সীমা নির্ধারণ করে।এই অর্থে নদীর দুই ধারের বৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে নদীর দুই কুল। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় একটি নদী---নদী ওঠে তার দুই-তীরের জন্যই।নদীর দুই তীরই তাকে বাধ্য করে সামনে এগিয়ে যেতে এবং এভাবেই নদী বেঁচে থাকে।'সাধনা' গ্রন্থে  তিনি এরকম অনুভূতির কথাই বলেছেন।
    তাঁর মতে,ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ফলে আমরা জগতের এক বিকৃত ছবি পাই,আর  একথা অনুভব করতে পারিনা যে বিশ্বব্যাপী এমন এক সত্তা আছে,যে সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।প্রায় দার্শনিক স্পিনোজার মতো তিনিও বলেছেন সত্য কখনো সাধারন চৈতন্য দ্বারা প্রকাশিত হয় না;এমনকি অংশের চেতনা দ্বারাও সত্য অপ্রকাশিত থেকে যায়।সত্য কেবল প্রকাশিত হয় সমগ্র চেতনা দ্বারা।বেহালার সমস্ত তার থেকে সুন্দর শব্দতরঙ্গকেই বাজানো যায়----কিন্তু একটি তার থেকে বেশুরো আওয়াজই বাজে।সকলেই তারগুলো নাড়াচাড়া করে কিছু শব্দ উৎপাদন করতে পারে।কিন্তু কেবল কয়েকজন প্রতিভাবানরাই পারে সত্যিকারের বেহালাবাদক হতে। সুতরাং এর থেকে তো বলা যাবেনা যে বেহালা তৈরি হয়েছে বিকৃত সুর উৎপাদনের জন্য? কবির এই উপমা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় তিনি সর্বোচ্চ সত্তার সৃষ্ট ঐক্যকে বুঝতে না পারার জন্য দায়ী করেছেন আমাদের আংশিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই।
    রবীন্দ্র-দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে আর এক ভিন্নশ্রেণীর সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়,যেখানে বলা হচ্ছে সৃষ্টির সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যেই আনন্দ আছে।প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে এই আনন্দ অনুভবের ক্ষমতা আছে।যদি নেপথ্যে একজন সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস না করা যায় তবে জীবন্ত আনন্দ তত্ত্বের ব্যাখ্যা করা যাবে কিভাবে? এই আনন্দকে অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করা যেত,যদি তা কেবল সুখ হতো, যা বিশেষ ব্যক্তিকে বিশেষ সময়ে সন্তুষ্টি দেয়।কিন্তু এই আনন্দ তো সুখ নয়।  এই আনন্দ এক বিশ্বব্যাপী বিষয়---যা প্রকাশকে অতিক্রম করে যায়।'বিশুদ্ধ আনন্দ', রবীন্দ্রনাথের মতে, স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত।
                                    ----------