Rabindranath Tagore
Nature of Religion (ধর্মের প্রকৃতি):
Nature of Religion (ধর্মের প্রকৃতি):
শিশুকাল থেকে ব্রাহ্মসমাজের আবহাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ বিকশিত হয়েছেন।তাই তার ধর্ম সম্পর্কিত চেতনায় ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবে ছিলই,পরবর্তীকালে হিন্দুত্বের কিছু বিষয়ও যুক্ত হয়েছিল। পরিণত বয়সে তাঁর ধর্ম সম্পর্কিত চেতনা আরো বিস্তার লাভ করে এবং তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন 'মানবিক ধর্মে' যা 'মানুষের ধর্ম' নামক গ্রন্থে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন,ধর্ম কখনো গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, উপজাতি, জাতি রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। মানুষ ধর্মের বিশেষ একটি আকৃতি গ্রহণ করতে পারে নিজের প্রয়োজন ও সুবিধামতো কিন্তু পরিণামে প্রকৃত ধর্ম সমস্ত বিশেষ আকৃতিকে অতিক্রম করে যায়।
যে দার্শনিক দর্শনকে সহজ করিয়া দেখাইতে পারেন তিনি যথার্থ ক্ষমতাশালী, ধীশক্তিমান যে সভ্যতা আপনার সমস্ত ব্যবস্থাকে সরলতার দ্বারা সুশৃঙ্খল ও সর্বত্র সুগম করিয়া আনিতে পারে সেই সভ্যতাই যথার্থ উন্নততর।বাহিরে দেখিতে যেমনই হোক, জটিলতাই দুর্বলতা, তাহা অকৃতার্থতা, পূর্ণতাই সরলতা। ধর্ম সেই পরিপূর্ণতার,সুতরাং সরলতার,একমাত্র চরমতম আদর্শ।
কিন্তু এমনি আমাদের দুর্ভাগ্য সেই ধর্মকেই মানুষ সংসারের সর্বাপেক্ষা জটিলতা দ্বারা আকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে।তাহা অশেষ তন্ত্রে-মন্ত্রে,কৃত্রিম ক্রিয়াকর্মে, জটিল মতবাদে,বিচিত্র কল্পনায় এমনি গহন দুর্গম হইয়া উঠিয়াছে যে,মানুষের সেই স্বকৃত অন্ধকারময় জটিলতার মধ্যে প্রত্যহ এক একজন অধ্যাবসায়ী এক এক নতূন পথ কাটিয়া নব নব সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিতেছে।সেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় ও মতবাদের সংঘর্ষে জগতে বিরোধ-বিদ্বেষ অশান্তি অমঙ্গলের আর সীমা নাই।
এমন হইল কেন? ইহার একমাত্র কারণ, সর্বান্তঃকরণে আমরা নিজেকে ধর্মের অনুগত না করিয়া,ধর্মকে নিজের অনুরূপ করিবার চেষ্টা করিয়াছি বলিয়া।ধর্মকে আমরা সংসারের অন্যান্য আবশ্যকদ্রব্যের ন্যায় নিজেদের বিশেষ ব্যবহারযোগ্য করিয়া লইবার জন্য আপন আপন পরিমাপে তাহাকে বিশেষভাবে খর্ব করিয়া লই বলিয়া।
ধর্ম আমাদের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যক সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই জন্যই তাহাকে নিজের উপযোগী করিয়া লইতে গেলেই তাহার সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যকতাই নষ্ট হইয়া যায়।তাহা দেশকালপাত্রের ক্ষুদ্র প্রভেদের অতীত, তাহা নিরঞ্জন বিকারবিহীন বলিয়াই তাহা আমাদের চিরদিনের পক্ষে আমাদের সমস্ত অবস্থার পক্ষে এত একান্ত আবশ্যক। তাহা আমাদের অতীত বলিয়াই তাহা আমাদিগকে নিত্যকাল সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে ধ্রুব অবলম্বন দান করে।
রবীন্দ্র-দর্শনে ধর্ম ও দর্শনকে পৃথক করার সমস্যা বিশেষ।দুই-এরই লক্ষ এক।দর্শন হলো 'সত্যের দৃষ্টি' আর ধর্মের লক্ষ্য হল মানব মনে ঐশ্বরিকতার সঙ্গে একত্বের উপলব্ধি।উভয়েই এক এবং অভিন্ন বিষয়কে নির্দেশ করছে।তবে এই 'নিজের সত্যপ্রকৃতির উপলব্ধি' ঐশ্বরিকতার সঙ্গে 'আত্মার একত্ব' ইত্যাদি বিষয়গুলি বিমুর্ত। অবান্তর বচনের অপব্যাখ্যা যাতে না হয় তার জন্য তিনি নির্দেশ করেছেন ধর্মে 'ভালোবাসা'র কথা।অসীমের উপলব্ধি হঠাৎ করে হওয়া সম্ভব নয়।আমাদের শুরু করতে হবে ভালোবাসা দিয়ে।আমাদের জীবন সম্পর্কে ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গির, আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারে অপরের প্রতি ভালোবাসা। বিশ্ব প্রকৃতির সকল প্রাণী, লতা, বৃক্ষ নদী, প্রান্তরের প্রতি মমত্ববোধ।এই মমত্ববোধই তার মধ্যে জন্ম দেবে এক বিশ্বব্যাপী একত্বের, এক বিশ্বজনীন ধর্মের।
ভালোবাসা,ত্যাগ,আন্তরিকতা এবং সরলতা এই দিয়ে তৈরি হয় প্রকৃত ধার্মিকের জীবন।রবীন্দ্রনাথ 'নিষ্পাপ ভালোবাসা'র শক্তিতে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে তিনি বলেছেন,সাংগঠনিক ধর্মের প্রয়োজনীয় জ্ঞান-----ধর্মকেই ধ্বংস করে দেয়। উপমা দিয়ে তিনি বলেছেন,পবিত্র মন্দির থেকে শিশুরা ছুটে পালিয়ে গিয়ে ধুলায় বসে খেলছে, ঈশ্বর ঐ শিশুদের খেলা লক্ষ্য করছেন-----পুরোহিতদের ভুলে গিয়েছেন।
----------